কক্সবাজারে বিমান বাহিনী সদস্যদের সাথে স্থানীয়দের সংঘর্ষের নেপথ্যে
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম [ ﷽ ]
১২:৩০ এম, শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫, ১ চৈত্র, ১৪৩১, ১৪ রমজান, ১৪৪৬
১২:৩০ এম, শনিবার,
১৫ মার্চ, ২০২৫,
১ চৈত্র, ১৪৩১,
১৪ রমজান, ১৪৪৬
শিরোনাম:

কক্সবাজারে বিমান বাহিনী সদস্যদের সাথে স্থানীয়দের সংঘর্ষের নেপথ্যে

টাইম টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক।। আপডেটঃ ১১:৩১ পিএম, শনিবার, ১ মার্চ ২০২৫ 17 বার পড়া হয়েছে

টাইম টিভি ২৪ ডটকম ফটো

কক্সবাজারে বিমান বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয়দের মধ্যে গত সোমবারের সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় সেখানে দুই পক্ষের সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়েছে। কিন্তু কেন সংঘর্ষ পর্যন্ত গড়ায়, এর নেপথ্যে কি রয়েছে- এ সব প্রশ্ন নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন করেছেন বিবিসি বাংলা।

সংঘর্ষে নিহত তরুণের মৃতদেহ দাফন করা হয় ঘটনার পরদিন গত মঙ্গলবার। এর পরদিনই বুধবার ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে কর্মকর্তাদের কাছে ধর্না দিচ্ছিলেন পিটিআইয়ের অবসরপ্রাপ্ত সুপার নাসির উদ্দিন। তখন সেখানেই নাসির উদ্দিনের সাথে দেখা হয় বিবিসি বাংলার এই সংবাদাতার।

নাসির উদ্দিন বলছিলেন, ছেলের ডেথ সার্টিফিকেট নিতে সকাল থেকে হাসপাতালের বিভিন্ন কক্ষে কক্ষে তিনি গিয়েছেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেথ সার্টিফিকেট দিতে গড়িমসি করছে। এরপর নাসির উদ্দিন টেলিফোনে বিষয়টি জানান কক্সবাজার সদর থানার ওসিকে।

“আমি যখন ওসিকে জানালাম, আমাকে সার্টিফিকেট দিতে নানা বাহানা করছে, তখন ওসি নিজে লোক পাঠিয়েছেন। হাসপাতালে পুলিশের লোকজন এসে কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছে”।

অবশেষে দুপুর পৌনে দুইটায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসকের কক্ষ থেকে ডেথ সাটিফিকেট হাতে বের হন নাসির উদ্দিন ও তার দুই মেয়ে। সেখান থেকে বেরিয়ে নিহত নাহিদের বোন নাদিয়া ফাতিমা কথা বলেন বিবিসি বাংলার সাথে। যিনি পেশায় একজন চিকিৎসক।

তিনি বলেন, “আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে এই হাসপাতালে আসার পর। সেখানে যখন আনা হয়েছে তারা তাকে দেখেছে- এসব রেকর্ড সবই তো হাসপাতালে আছে। তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছে, সেখানে লেখা হয়েছে মাথায় আঘাতজনিত কারণে মারা গেছে আমরা ভাই”।

সকাল থেকে নানা চেষ্টার পর ডেথ সার্টিফিকেট তারা হাতে পেয়েছেন। তবে সেটি তারা প্রত্যাখ্যান করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান।

কক্সবাজারে সেই সংঘর্ষের ঘটনার পর হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে বিক্ষোভ মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে স্থানীয়দের।

কেন বা কি কারণে হঠাৎই এমন একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলো সেটি নিয়ে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে স্থানীয় বাসিন্দা, জেলা প্রশাসন, প্রত্যক্ষদর্শী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের জমিতে বিমান বাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ে স্থানীয়দের সাথে সংকট চলছে কয়েক বছর ধরে। যার ধারাবাহিকতায় সোমবারের ওই সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছে।

কেন ডেথ সার্টিফিকেট প্রত্যাখান?
কক্সবাজার পিটিআইয়ের অবসরপ্রাপ্ত সুপারিনটেনডেন্ট নাসির উদ্দিনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলেন শিহাব কবির নাহিদ। তিনি ছিলেন পরিবারের সবার ছোট। বুধবার সকালে নাসির উদ্দিন তার যে দুই মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যান; ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পরিবারের ওই তিনজন সদস্যই।

সাটিফিকেট পাওয়ার পর ছোট মেয়ে নাদিয়া ফাতিমা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যখন ডেথ সাটিফিকেট লেখা হয় আমরা তখন সেখানেই ছিলাম। ওখানকার একজন চিকিৎসক ফোনে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার মৃত্যুর কারণ কি লিখবো?”

ফাতিমার অভিযোগ, হাসপাতালের চিকিৎসকেরা প্রভাবিত হয়ে এ ধরনের রিপোর্ট দিয়েছে। যে কারণে তারা এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন বলেও জানান ফাতিমা।

নিহত নাহিদের বোন নুসরাত জাহান বলেন, “সংঘর্ষের সময়কার ফুটেজ, স্থানীয়দের দেখা ঘটনা সব কিছুতে স্পষ্ট আমার ভাই গুলিতে মারা গেছে”। কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেটে সেই বিষয়টি পুরোপুরি গোপন করা হয়েছে। আমরা এই মৃত্যু সার্টিফিকেট মানি না। এটি আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম”।

এত চেষ্টার পর সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে হাসপাতাল থেকে রেব হয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, “আমি সন্তানকে আর কোনদিন পাবো না এই সত্য মেনে নিয়েছি। কিন্তু ছেলের বিচারের পথও বুঝি বন্ধ হয়ে গেলো এই রিপোর্টের মধ্য দিয়ে”।

মাথায় আঘাত জনিত কারণে মৃত্যু লেখার বিষয়টি চাপে করা হয়েছে বলে পরিবার দাবি করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছে।

হাসপাতারের তত্ত্বাবধায়ক মং টিং ঞো বলেন, “ডেথ সার্টিফিকেট কারো চাপে পরিবর্তন করা হয় নি। যখন ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যাবে, তখন তাতে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে”।

ওই ডেথ সার্টিফিকেট লিখেছিলেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এস এম আশরাফুজ্জামান। তিনি জানিয়েছেন, নিহত নাহিদের শরীরের ভেতর কোন বুলেট তারা পাননি। তবে আরো বিস্তারিত জানা যাবে ময়না তদন্ত রিপোর্টে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেদিনের ঘটনা
স্থানীয় বাসিন্দা সাবের আহমেদ জানান, সোমবার সকালে তার ছেলে জাহেদুলকে বিমান বাহিনীর চেকপোস্ট থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় সেদিনের সংঘর্ষ।

তিনি বলেন, “আমরা এলাকার লোকজন সবাই যখন খবর পাইলাম জাহেদুলকে ধইরা নিয়া গেছে বিমান বাহিনীর লোকজন, তখন এলাকার সবাই তাকে ধরে আনতে রওনা দিছিলো”।

ওই দিনের ঘটনার সময় সেখানে ছিলেন এমন অন্তত পাঁচ জনের সাথে কথা বলে বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে জাহেদুলকে বিমান বাহিনীর চেকপোস্ট থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরই এলাকাবাসী ক্ষুদ্ধ হন এবং বিমান বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়ান।

স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান সে সময় ছিলেন ওই সংঘর্ষের মাঝেই। তিনি জানান, তার ঠিক পাশেই ছিলেন শিহাব কবির নাহিদ। এদিক থেকে এলাকাবাসী যখন বিমান বাহিনীদের দিকে লক্ষ করে ইট পাটকেল ছুড়ছিল তখন বিপরীত দিক থেকে গুলি করা হয়।

মিজানুর রহমানের দাবি এক পর্যায়ে তিনি দেখতে পান যে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে নাহিদ। বুধবার বিবিসি বাংলার কাছে বেশ কিছু ফুটেজও দেখান তারা।

যদিও ঘটনার দিনে বিকেলে আইএসপিআর বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষার্থে বিমান বাহিনীর সদস্যরা তাদের বিধান অনুযায়ী ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তবে স্থানীয় জনসাধারণের উপর সরাসরি গুলি ছোড়া হয়নি।

কক্সবাজারে বিমান বাহিনীর সদস্যদের সাথে স্থানীয়দের ওই দিনের সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনার পর ক্ষোভ বাড়ছে কুতুবদিয়াপাড়া ও সমিতিপাড়ার মানুষের মাঝে।

সংঘর্ষের নেপথ্যে কী?
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষা এই এলাকাটি মানচিত্রে ছিল না অর্ধশতক আগেও। বঙ্গোপসাগরের চর থেকে নতুন মানচিত্রের জন্ম হলে, সেখানেই বসতি গড়েন আশপাশের নদী ভাঙন এলাকার বাসিন্দারা। বিশাল এলাকাজুড়ে তারাই গড়ে তোলেন শুটকি পল্লী।

সরকারি এই খাস জমির ৬৮২ একর এলাকা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে বরাদ্দ দেয় জেলা প্রশাসন। মূলত এ নিয়েই সংকট চলছে গত কয়েক বছর ধরে।

গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর স্থানীয় বাসিন্দারা এই খাস জমিতে দখল ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিলে এ নিয়ে স্থানীয়দের সাথে টানাপোড়েন তৈরি হয় বিমান বাহিনীর।

এজবত উল্লাহ কুতুবী নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরে এই এলাকা গড়ে তুলেছি। আমরা নদী ভাঙন এলাকার লোক। এখান থেকে আমাদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চলছে দীর্ঘদিন ধরে।

স্থানীয় শিক্ষক ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের অনেকেই জানান, কক্সবাজার বিমান বাহিনীর ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকাটি খাস জমি হওয়ার কারণে নদী ভাঙন এলাকার মানুষেরা এখানে থাকছে।

বিমান বন্দর সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন কথা বলে স্থানীয়দের এই খাস জমি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় স্কুল শিক্ষক ইকবাল বাহার।

ইকবাল বাহার বলেন, “নানা অযুহাতে এই এলাকার মানুষদের হয়রানি করা হচ্ছে। এখানে বিমান বাহিনী বিনা কারণে তিন চারটি চেকপোস্ট বসিয়ে মানুষকে নানা হয়রানি করছে। এসব কারণে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ”।

কক্সবাজারে বিমানবন্দর ও বিমানঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য কয়েক বছর ধরে শহরের এক নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া ও কুতুবদিয়া পাড়া এলাকার কয়েক হাজার মানুষকে উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয় প্রশাসন।
যে কারণে সেখানে এখনো পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে স্থানীয়রা উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলো।

সোমবার সকালে স্থানীয় সমিতিপাড়া এলাকার জাহেদুল ইসলামকে বিমান বাহিনী চেকপোস্ট থেকে ধরে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ওই দিনের সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানান স্থানীয়রা।

এ নিয়ে কথা বলতে বিবিসি বাংলা গিয়েছিল কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। সেখানকার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “খাস জমির একটি অংশ বিমান বাহিনীকে বরাদ্দ দেয়া হয় আগেই, এবং সেটি বাহিনীটির দখলেই রয়েছে। আরেক অংশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে বরাদ্দ দেয়া হলেও সেটি এখনো স্থানীয়দের দখলে রয়েছে”।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের জমিতে বিমান বাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ে স্থানীয় সাথে সংকট চলছে কয়েক বছর ধরে। যার ধারাবাহিকতায় সোমবারের ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

টাইম টিভি ২৪ ডটকম/জাতীয়

মন্তব্য করুন

আপলোডকারীর তথ্য

tttv-admin

আপলোডকারীর সব সংবাদ
শিরোনাম: